ফটোজেনিক মেধাবী ও প্রশ্নফাঁস!

এম মাহাবুবুর রহমান:: আজ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য উপভোগ করছিলাম! কারাবন্দী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে তিনি যখন কথা বলছিলেন, শুরুতে তাকে অনেকটা ভঙ্গুর মনে হচ্ছিল। এক-এগারো সরকারের দায়ের করা মামলায় খালেদা জিয়ার জেল হয়েছে, এতে আমরা কিছুই করা নেই। কিন্তু তিনিও যে একইসময়ে ১২টি মামলার আসামী ছিলেন, এমন প্রশ্ন করার সাহস আমাদের কোনো সাংবাদিক বন্ধু করতে সমর্থ হননি। পক্ষান্তরে, চ্যানেল ওয়ানের সাবেক চীফ রিপোর্টার শাকিল আহমেদের স্ত্রী ফারজানা রুপার অসাংবাদিকতাসুলভ হাইওয়েট ওয়েলিং প্রশ্নের পর শেখ হাসিনার মুখে খই ফুটতে শুরু করে।
তবে শেখ হাসিনার বক্তব্য শুনে উপস্থিত অধিকাংশ সাংবাদিকের মধ্যেই একটি বিরক্তি ভাব লক্ষ্য করা গেছে। হাসিনা-ভক্ত মোজাম্মেল বাবুর চেহারাও ছিল মলিন। আমাদের সময় সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খানকে কিছুটা ইন্টারেকটিভ মনে হলেও তিনি উদ্ভুত পরিস্থিতিতে কোনো প্রশ্ন করারই সাহস পাননি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সাবেক সভাপতি ও মাছরাঙা টিভির সাংবাদিক রেজোয়ানুল হক রাজা প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন। প্রশ্ন উত্থাপনের পর হয়তো সবার আগ্রহ ছিল শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালনে অক্ষমতা নিয়ে শেখ হাসিনা মিনিমাম উষ্মা প্রকাশ করবেন। কিন্তু শেখ হাসিনা উপস্থিত সাংবাদিকদেরকে উল্টো পুলিশী দায়িত্ব প্রদান করলেন। প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনাকে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে তিনি উড়িয়ে দিলেন। বললেন, সাংবাদিকরা প্রশ্নফার্সকারী কাউকে ধরে এনে দিতে পারলে তিনি শাস্তি দেবেন!!
‘দুই ঘন্টা থেকে আধা ঘন্টা আগে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে‘ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বাংলা শব্দভান্ডারে নতুন একটি শব্দ যোগ করলেন। ‘ফটোজেনিক মেধাবী‘। বললেন, এমন ফটোজেনিক মেধাবী কেউ কি আছেন যে, দুই ঘন্টা আগে প্রশ্ন হাতে পেয়ে পরীক্ষায় ভাল ফল করবেন!!! কেউ এমন ফটোজেনিক মেধাবী কখনো দেখেছেন??
এই কথাগুলো যখন শুনছিলাম, তখন আমার মাথা ও শরীর কেমন যেন নড়ে ওঠে। আমি কাঁপতে থাকি। মনে হচ্ছিল, শরীরটা ক্রমশ শীতল হয়ে আসছে। ভাবছিলাম, আমি কার বক্তব্য শুনছি। এসব কি কোনো রাষ্ট্রের কর্তা ব্যক্তির বক্তব্য? এমন বক্তব্য দেয়ার পর তিনি কিভাবে ‘প্রধানমন্ত্রী‘ হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন?
এসব প্রশ্ন নিজেকে নিজেই করছিলাম। আর একটু মিলিয়ে দেখছিলাম, আমার নিজের পরীক্ষা সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা। গত এক দশক ধরে আমি ব্রিটিশ কাউন্সিলে আইইএলটিএস পরীক্ষার সাথে যুক্ত। আমরা দেখেছি, একটি পরীক্ষার প্রতি মানুষের আস্থা নিশ্চিত করতে কিভাবে বিশ্বব্যাপী একযোগে আইইএলটিএস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
যুক্তরাজ্যে আমি বিখ্যাত লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিকস এন্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সে গত তিন বছর ধরে পরীক্ষা কার্যক্রমের সাথে জড়িত। পরীক্ষা শুরুর দুই ঘন্টা আগে আমরা প্রশ্নপত্র রিসিভ করি। এরপর পাঁচ মিনিট আগে পরীক্ষার্থীদের হাতে প্রশ্নপত্র পৌঁছাই। কিংস কলেজ লন্ডনেও গত সাড়ে তিন বছর পরীক্ষা কার্যক্রমে জড়িত আছি। ব্রিটিশ কাউন্সিল ক্যামব্রিজ এবং লন্ডন ব্রাঞ্চের আইইএলটিএস পরীক্ষা ও মার্কিং কার্যক্রমেও সংশ্লিষ্টতা আছে।
উন্নত বিশ্বের এসব অভিজ্ঞতার সাথে শেখ হাসিনার বক্তব্য মিলাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম, কেমনে কি? শেখ হাসিনার ভাগ্নি টিউলিপ কিংস কলেজ লন্ডনের ছাত্রী ছিলেন। ছোট ভাগ্নী এলএসই-র ছাত্রী। আমি দু‘টি প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা কার্যক্রমের সাথেই যুক্ত আছি। শেখ হাসিনার ভাগ্নীরা যদি তার বক্তৃতা শুনে থাকে, তাদের অবস্থাও আমার মতো হবে। তাদের খালা যেই দেশের প্রধানমন্ত্রী, সেই দেশে প্রশ্নফাঁস একটি স্বাভাবিক ঘটনা। যদি কোনোদিন, প্রশ্ন ফাঁস না হয় সেটি পত্রিকায় সংবাদ বের হয়!!
এই বক্তব্য শোনার পর অবশ্য শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত কিছু সাংবাদিককে কিছুটা আপসেট দেখাচ্ছিল। তাদের প্রিয় নেত্রী কিভাবে এমন নেতিবাচক পরিস্থিতি শামাল দিবেন এই চিন্তায় তারা ছটফট করছিলেন। তাই তৎক্ষণাৎ প্রিয় নেত্রীকে সহায়তা করতে একজন সাংবাদিক সাইড টকিং করে জানালেন, মাত্র আধা ঘন্টা আগে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে থাকে। হাসিনা-ভক্ত সাংবাদিক মোজাম্মেল বাবু অবশ্য নিশ্চুপ ছিলেন। তাকে কিছুটা নির্জীব মনে হচ্ছিল। কারন তার একাত্তর টিভি ‘এক/দুই দিন আগেই প্রশ্ন ফাঁস হয়ে থাকে‘ এমন সংবাদ আগেই প্রচার করেছিল। উপস্থিত কিছু সাংবাদিককে ‘খুশি‘ ‘খুশি’ লাগছিল। কারন তাদের প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনা প্রশ্ন ফাঁস সংক্রান্ত ‘সংবাদের প্রকৃত সংজ্ঞা’ নির্ধারণ করে দিয়েছেন এই সংবাদ সম্মেলনে। অর্থাৎ, প্রশ্ন ফাঁস বাংলাদেশে একটি স্বাভাবিক ঘটনা। যুগ যুগ ধরে প্রশ্নফাঁসের ধারা চলে আসছে। অতএব, প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করলে তা ‘সংবাদ‘ হবে না। কেবল ব্যতিক্রম হিসেবে যেদিন প্রশ্নফাঁস হবে না, সেটিই সংবাদ হিসেবে প্রকাশ/প্রচার করা যাবে। অর্থাৎ, ‘কোনো ব্যতিক্রম ও অস্বাভাবিক ঘটনাই সংবাদ, যা সাধারণের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়।‘
সো, বয়েজ এন্ড গার্লস, আজকে শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলন থেকে বাংলাদেশের সাংবাদিকরা কি শিক্ষা পেলেন? প্রথমত: বাংলা সংবাদ ভান্ডারে ‘ফটোজেনিক মেধাবী‘ নামে নতুন অর্থবোধক একটি শব্দের সংযোগ! দ্বিতীয়ত: প্রশ্নফাঁস স্বাভাবিক ঘটনা। অতএব এটি সংবাদ নয়। প্রশ্নফাঁস না হওয়াটাই সংবাদ!!
More News from মতামত
-
-
বাংলাদেশে বিদেশি অতিগুরুত্বপূর্ণ অতিথিদের সফরকালীন নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ
-
কোভিড-প্রতিষেধক টিকাগুলি বড়জোর এক বছরেরও আগে অকেজো হয়ে পড়তে পারে
-
-
লকডাউন পরিস্থিতির পর এই প্রথম বিদেশ (বাংলাদেশ) সফর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর